উচ্চ রক্তচাপ কেন হয়? লক্ষন, কারণ ও ঘরোয়া প্রতিকার জেনে নিন।
ভূমিকা:
হাই ব্লাড প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ বর্তমানে একটি নীরব ঘাতকের ভূমিকা পালন করছে। সুযোগ পেলেই ছোবল বসিয়ে দিচ্ছে যার তার বুকে। কথাটা রসিকতার ভাবে বললাম কিন্তু রোগটা মোটেও রসিকতার নয়। কথায় বলে যার হয় সেই জানে। ভাবতে গেলে খুবই খারাপ লাগে। কোনো কোনো পরিবারকে একদম নীরবে শেষ করে দিচ্ছে। এই সমস্যায় অনেকেই ভুগছেন প্রাথমিক অবস্থায় কেউ বুঝতে পারছেন না। প্রাথমিক অবস্থায় তেমন কিছু লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না। সঠিক সময়ে লক্ষণ না পেলে বা বুঝতে না পারলে সময় মতো প্রতিকার না করতে পারলে এটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়, স্ট্রোক হয়ে যায়। এমনকি কিডনি বিকলের মত গুরুতর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা আজকে এই ব্লগে জানবো উচ্চ রক্তচাপ কি? এর প্রধান কারণ লক্ষণ এবং ঘরোয়া ও প্রাকৃতিক উপায়ে কিভাবে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
১. উচ্চ রক্তচাপ কি?
উচ্চ রক্তচাপ হচ্ছে এমন একটা শারীরিক অবস্থা যেখানে রক্তনালীর ভিতর দিয়ে রক্ত প্রবাহের সময় চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়। এই চাপকে বাড়তি চাপ বা উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। এই চাপ যদি দীর্ঘ সময় ধরে বেশী থাকে, তাহলে এই অবস্থা কে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ বলে। দীর্ঘদিন হাইপারটেনশনে ভুগলে হৃৎপিন্ড, কিডনি, চোখ ও মস্তিষ্ক সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি সাধন করে।
* আমাদের শরীরের রক্ত দুটি সংখ্যায় বলে থাকি।
(ক) উপরের সংখ্যা বা সিস্টোলিক প্রেসার:
যখন হৃৎপিন্ড রক্ত পাম্প করে তখন যে চাপ দেয়, তাকে আমরা সিস্টোলিক প্রেসার বা উপরের সংখ্যা বলি।
(খ) নিচের সংখ্যা বা ডায়াসটোলিক প্রেসার:
যখন হৃৎপিন্ড বিশ্রামে তখন যে চাপ তৈরি হয় তাকে আমরা নিচের সংখ্যা বা ডায়াসটোলিক প্রেসার বলি।
আমাদের শরীরের স্বাভাবিক রক্তচাপ এর সংখ্যা হলো 120/80 mmHg. এই সংখ্যার বেশি হলে আমরা তখন High Blood Pressure বা উচ্চ রক্তচাপ বলে।
২. উচ্চ রক্তচাপের কারণ সমূহ:
(ক) খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার ধরণ।
আমাদের শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় যদি বেশি খাওয়া দাওয়া করা হয় তাহলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে উচ্চ রক্তচাপ তৈরী করে। প্রতিদিন ২৮০০ থেকে ৩০০০ ক্যালোরি এর বেশী গ্রহণ করা হয় তাহলে ধীরে ধীরে রক্তের মধ্যে সুগারের মাত্রা বেড়ে গিয়ে শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। সেই চাপ একদিন উচ্চ রক্তচাপে পরিনত হয়। জীবন যাত্রার কুঅভ্যাসেও রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। যেমন – ধুমপান, মদ্যপান ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের নেশা উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি করে।
(খ) মানসিক চাপ ও ঘুমের অভাব:
মানসিক চাপ থাকলে এবং ঘুম ঠিকঠাক না হলে উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয়।। একটু ভেঙে বলি মানসিক চাপকে আমরা টেনশন বলি। মানসিক চাপ যদি বেশি হয় তাহলে সূত্রের আকারে বলা যায়, মানসিক চাপ=Tension, বেশি=High. অতএব বলা যায় বেশি মানসিক চাপ=Hypertension=উচ্চ রক্তচাপ।
তাহলে অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন মানসিক চাপ এবং উচ্চ রক্তচাপ কিভাবে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। আবার মানসিক চাপ থাকলে ঘুম আসে না। ঘুম না এলে মানুষ শুয়ে শুয়ে শুধু ভাবতেই থাকে বা দুশ্চিন্তা করতে থাকে। বেশি দুশ্চিন্তা করলে উচ্চ রক্তচাপের কি করে। এখানে বলা যায় ঘুম না হলে প্রেসার বাড়ে আবার প্রেসার বাড়লে ঘুম আসে না। এখানেই বোঝা যাচ্ছে একটা সাথে আর একটা কিরকম ভাবে যোগ সাধন করে আছে।
(গ) জেনেটিক বা বংশগত কারণ:
আমরা শরীরের গঠন বৈশিষ্ট্য পাই আমাদের মা এবং বাবার কাছ থেকে। আর আমার বাবা-মা পেয়েছে তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে। অতএব এখানে বোঝা যাচ্ছে পূর্ব পুরুষের গঠনগত বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমে আমাদের মধ্যে চলে এসেছে। যদি কোন বংশের হৃৎপিণ্ডের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য যদি এমন থাকে যে ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে হৃদপিন্ডের কার্যক্ষমতা কমে যাবে। সেই বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সেই বংশের প্রায় প্রত্যেকেরই প্রায় একই রকম ভাব প্রকাশ পাবে।
(ঘ) বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অসুস্থতা:
কোন কারণে যদি কোন ব্যক্তি কোন জটিল রোগে আক্রান্ত হয় যেমন কিডনির রোগ ডায়াবেটিস , হাঁপানি রোগ ইত্যাদি রোগে যদি আক্রান্ত হয় তাহলে তার উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেবে।
৩. উচ্চ রক্তচাপের সাধারণ করণ:
(ক) মাথা ব্যাথা ও ক্লান্তি ভাব।
(খ) চোখে ঝাপসা দেখা।
(গ) বুক ধড়ফড় করা।
(ঘ) নিঃশ্বাসে কষ্ট।
৪. প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া প্রতিকারের উপায়:
উচ্চ রক্তচাপ শুধু মাত্র ওষুধেই নয়, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও সঠিক জীবন যাপনের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবেও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। নিচে কিছু ঘরোয়া ও প্রাকৃতিক উপায় দেওয়া হলো যেগুলো নিয়মিত মেনে চললে রক্তচাপ অনেকটাই স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়।
(ক) সুষম খাদ্য গ্রহণ।
আমরা সুষম খাদ্য বলতে বুঝি ভাত, রুটি, সবজি, মাছ, দুধ, ফল, বাদাম, মসুরডাল, মুগ ডাল এবং বিভিন্ন ধরনের তরকারি। আমি এখানে বলতে চাই সুষম খাদ্য গ্রহণ করবো আবার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও রাখবো। যেমন মাছ খাবো ঠিকই কিন্তু ছোট মাছ বেশি আর বড়ো মাছ কম খাবো বা পরিমাণ মতো খাবো। মাছে ওমেগা থ্রি থাকে যা আমাদের হার্ট ভালো রাখতে সাহায্য করে। এই রকম সবরকম সুষম খাদ্যই খাবো কিন্তু পরিমাণ মতো খাবো।
(খ) লবণ খাওয়াই নিয়ন্ত্রণ।
মনে রাখতে হবে প্রতিদিন পাঁচ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়।
(গ) নিয়মিত যোগ ব্যায়াম করা ও হাটা:
প্রতিদিন শরীর চর্চা অর্থাৎ যোগ ব্যায়াম করলে এবং কমপক্ষে সকালে আধ ঘন্টা থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটলে বা দৌড়ালে শরীরে চর্বিজমতেপারে না। অতিরিক্ত চর্বি বা ভ্যাট শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই প্রতিদিন যোগ ব্যায়াম করা, হাঁটা, শরীর চর্চা করা খুব দরকার।
(ঘ) মেডিটেশন:
মেডিটেশন বা ভ্যান হল এক ধরনের মানসিক অনুশীলন। চোখ বন্ধ করে মনকে শান্ত করে রাখাটাই মেডিটেশন বা ধ্যান। এটি সাধারনত একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে চোখ বন্ধ করে, নিঃশ্বাসের প্রতি মনোযোগ দিয়ে বা কোন মন্ত্র জপ করে করা হয়। মেডিটেশন আমাদের মনকে চাপমুক্ত করতে সাহায্য করে। একাগ্রতা বাড়াতেও সাহায্য করে এবং মনের ভারসাম্য বজায় রাখতেও সাহায্য করে। আজকের ব্যস্ততার জীবনে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, উত্তেজনা এবং ঘুমের সমস্যা খুবই দেখা দিয়েছে। তাই মেডিটেশনই পারে এই সমস্ত সমস্যাগুলোর সমাধান করতে। এটা একটা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক এবং সহজ উপায়। নিয়মিত মেডিটেশন করলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। হৃদ যন্ত্র সুস্থ থাকে এবং মানসিক শান্তি বজায় থাকে।
(ঙ) রসুন খাওয়া:
রসুনে আছে অ্যালিসিন নামক একটি উপাদান। এই উপাদানটি রক্তনালীর প্রসারণ ঘটিয়ে উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। প্রতিদিন সকালবেলায় খালি পেটে এক থেকে দুই কোয়া কাঁচা রসুন খেলে এই উপকারটি পাওয়া যায়।
(চ) তুলসী পাতা ও অশ্বগন্ধা:
তুলসী পাতা ও অশ্বগন্ধা দুটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক বা আয়ুর্বেদিক উপাদান। এই উপাদান দুটি নিয়মিত সঠিক মাত্রায় গ্রহণ করলে মানসিক চাপকে কমিয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
(ছ) পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার:
কলা, টমেটো, মিষ্টি আলু, পালং শাক নিয়মমাফিক অর্থাৎ নিয়মিত এবং পরিমাণ মতো খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এই খাবারগুলোকে পটাশিয়ামযুক্ত খাবার বলা হয়। পটাশিয়াম যুক্ত খাবার খেলে সোডিয়ামের প্রভাব কমায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
৫. কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন:
রক্তচাপ কখন যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তা আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না। ঘরোয়া প্রতিকারে যদি কাজ না হয় তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। নিচে কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ দিয়ে দিলাম যদি এই উপসর্গগুলো দেখা দেয় তাহলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
(ক) বুকে চাপ, ব্যথা বা বুক ধরফর করে।
(খ) বারবার মাথা ঘোরা বা অস্পষ্ট দৃষ্টিশক্তি।
(গ) প্রচন্ড মাথা ব্যথা বা মাথার পিছনে তানভব।
(ঘ) শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
(ঙ) হাত পা অসাড় হয়ে আসা বা দুর্বল ভাব লাগা।
(চ) ঘন ঘন নাক দিয়ে রক্ত পড়া।
(ছ) অস্থির ভাব বা অসস্তি ভাব।
(জ) যদি রক্তচাপ 160/100 mmHg
বা তার বেশি থাকে তাহলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।