You are currently viewing থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন? জানুন কারণ, লক্ষণ ও ঘরোয়া প্রতিকার!

থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন? জানুন কারণ, লক্ষণ ও ঘরোয়া প্রতিকার!

থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন? জানুন কারণ, লক্ষণ ও ঘরোয়া প্রতিকার!

ভূমিকা:

বর্তমান সময়ে থাইরয়েড সমস্যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মধ্যে বেশি দেখা দিয়েছে মেয়েদের মধ্যে। থাইরয়েড, এটি এমন একটি গ্রন্থি যা শরীরের বিপাক, শক্তি উৎপাদন, হরমোন ব্যালেন্স ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এই সমস্যাটি অবহেলা করলে ধীরে ধীরে এটি অন্যান্য জটিল রোগের জন্ম দিতে পারে। তাই সময়মতো সচেতনতা দরকার ও প্রতিকার করাও অত্যন্ত জরুরি।

থাইরয়েড কী?

থাইরয়েড একটি প্রজাপতির মতো দেখতে অঙ্গ যা গলার ঠিক সামনের দিকে থাকে। এই গ্রন্থি T3 (Triiodothyronine) ও T4 (Thyroxine) নামক হরমোন নিঃসরণ করে যা শরীরের মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করে।

থাইরয়েড সমস্যার ধরন:

১. হাইপোথাইরয়েডিজম (Hypothyroidism):

থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হলে শরীর ধীরগতিতে কাজ করে। থাইরয়েড হরমোন যখন প্রয়োজনের তুলনায় কম নিঃসরণ হয় তখন তাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলে। হাইপো মানে কম।

২. হাইপারথাইরয়েডিজম (Hyperthyroidism):

থাইরয়েড হরমোন যখন অতিরিক্ত নিঃসরণ হয় তখন শরীর অতিরিক্ত গতিতে কাজ করে। হাইপার মানে বেশী। তাই এই সময় হাইপারথাইরয়ডিজম বলা হয়।

উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ:

১. অটোইমিউন রোগ (যেমন Hashimoto’s Thyroiditis বা Graves’ Disease)।

২. আয়োডিনের ঘাটতি।

৩. থাইরয়েড অপারেশন বা চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

৪. গর্ভাবস্থায় হরমোন পরিবর্তন।

৫. দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রেস।

৬. বংশগত প্রভাব।

উল্লেখযোগ্য লক্ষণসমূহ:

হাইপোথাইরয়েডিজম-এর লক্ষণ:

১. অতিরিক্ত ক্লান্তিতে ভোগে।

২. ওজন বৃদ্ধি হয়ে যায়

৩. ঠান্ডা অনুভব হয়।

৪. চুল পড়তে শুরু করে।

৫. মনোযোগের অভাব ঘটে।

৬. ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়।

৭. ডিপ্রেশনে পড়ে যায়।

হাইপারথাইরয়েডিজম-এর লক্ষণ:

১. হঠাৎ ওজন কমতে থাকে।

২. অতিরিক্ত ঘাম হয়।

৩. মাঝে মাঝে বুক ধড়ফড় করে।

৪. অনিদ্রা বা ঘুম কমে যায়।

৫. নার্ভাসনেস অনুভব করতে থাকে।

৬. চোখ বড় হয়ে যায়।

৭. মাসিকের অনিয়ম দেখা দেয়।

থাইরয়েড সমস্যা কাদের বেশি হয়?

৩০–৫০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

পরিবারে কারো এই রোগ থাকলে

যাদের গর্ভাবস্থায় জটিলতা হয়েছে

ডায়াবেটিস বা অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা

থাইরয়েড নির্ণয়ের উপায়:

রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে T3, T4 ও TSH পরিমাপ

আল্ট্রাসোনোগ্রাফি (থাইরয়েড নোডুল চেকের জন্য)

থাইরয়েড স্ক্যান (বিশেষ ক্ষেত্রে)

চিকিৎসা পদ্ধতি:

১. হাইপোথাইরয়েডিজমে সাধারণত লেভোথাইরক্সিন (Levothyroxine) নামক ওষুধ ব্যবহার করা হয়।

২. হাইপারথাইরয়েডিজমে ব্যবহার হয় মেথিমাজোল (Methimazole) বা প্রোপিলথাইউরাসিল (PTU)।

কিছু ক্ষেত্রে রেডিওআ্যাকটিভ আয়োডিন থেরাপি অথবা অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে।

ঘরোয়া প্রতিকার ও লাইফস্টাইল টিপস:

১. আয়োডিনযুক্ত খাবার খান:

যেমন-

(ক) সামুদ্রিক মাছ খান।

(খ) ডিম খান।

(গ) দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খান।

(ঘ) আয়োডিনযুক্ত লবণ খান।

২. সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খান:

(ক) বাদাম (বিশেষ করে Brazil nuts) খান।

(খ) ডাল খান।

(গ) ডিম খান।

৩. জিঙ্ক ও আয়রন যুক্ত খাবার খান:

(ক) কুমড়ার বীজ খান

(খ) পালং শাক খান।

(গ) মাংস খান।

(ঘ) বেদানা খান।

৪. ব্যায়াম করুন ও শরীর চর্চা করুন:

প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটুন।

যোগব্যায়াম (যেমন শ্বাসব্যায়াম, সর্বাঙ্গাসন, মৎস্যাসন)

৫. স্ট্রেস কমান:

(ক) মেডিটেশন করুন।

(খ) পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান।

(গ) মাইন্ডফুলনেস চর্চা করুন।

৬. ক্যাফেইন ও সুগার কমান:

চা, কফি, সফট ড্রিংক এড়িয়ে চলুন

চিনি জাতীয় খাবার কম খান।

প্রতিরোধের সহজ উপায়:

১. নিয়মিত হেলথ চেকআপ করুন।

২. হরমোন লেভেল মনিটর করুন।

৩. ওষুধ খাওয়ার সময় মেনে চলুন।

৪. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও রুটিন তৈরি করুন।

বিশদ ব্যাখ্যা “হাইপো” ও “হাইপার” থাইরয়েডের মধ্যে পার্থক্য:

হাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপারথাইরয়েডিজম – এই দুটি রোগ থাইরয়েড গ্রন্থির অসাম্যজনিত দুটি বিপরীত অবস্থা। হাইপোথাইরয়েডিজমে থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত পরিমাণে হরমোন তৈরি করতে পারে না, ফলে দেহের মেটাবলিজম ধীরগতি হয়ে যায়। এর ফলে রোগীর মধ্যে অবসাদ, ওজন বেড়ে যাওয়া, ঠান্ডা লাগা, চুল পড়া, কোষ্ঠকাঠিন্য ও মনোযোগে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে, হাইপারথাইরয়েডিজমে থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত হরমোন তৈরি করে, যার কারণে মেটাবলিজম বেড়ে গিয়ে অতিরিক্ত ঘাম, ওজন হ্রাস, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, হাত কাঁপা ও ঘুমে ব্যাঘাতের মতো সমস্যা দেখা দেয়।

হাইপোথাইরয়েডিজমে সাধারণত T3 ও T4 হরমোনের মাত্রা কমে যায় এবং TSH হরমোন বেড়ে যায়, যেখানে হাইপারথাইরয়েডিজমে T3 ও T4 বেড়ে যায় এবং TSH কমে যায়। হাইপোর প্রধান কারণ হলো আয়োডিনের ঘাটতি, হ্যাশিমোটো ডিজিজ বা কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ, আর হাইপারের মূল কারণ হলো গ্রেভস ডিজিজ, থাইরয়েড টিউমার বা অতিরিক্ত আয়োডিন গ্রহণ। হাইপোথাইরয়েডিজমের চিকিৎসায় থাইরয়েড হরমোন সাপ্লিমেন্ট (যেমন লেভোথাইরক্সিন) দেওয়া হয়, আর হাইপারথাইরয়েডিজমে এন্টি-থাইরয়েড ওষুধ, রেডিওঅ্যাকটিভ আয়োডিন বা অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। সংক্ষেপে, হাইপো ও হাইপারথাইরয়েডিজম একে অপরের বিপরীত হলেও উভয় সমস্যাই নিয়মিত চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

উপসংহার:

থাইরয়েড সমস্যা এখন সাধারণ হলেও সচেতনতা ও সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাই শরীরে যদি কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং ঘরোয়া উপায়েও শরীরকে সুস্থ রাখুন। থাইরয়েড একটি ছোট গ্রন্থি হলেও এর প্রভাব শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর পড়ে। তাই থাইরয়েডের সমস্যা যেমন হাইপোথাইরয়েডিজম বা হাইপারথাইরয়েডিজম অবহেলা করলে শরীরের নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে। সঠিক সময়ে রোগ চিহ্নিত করে চিকিৎসা শুরু করলে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম থাইরয়েড সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। তাই যদি উপসর্গ দেখা যায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং শরীরের প্রতি সচেতন হোন—কারণ সুস্থ থাইরয়েড মানেই সুস্থ জীবন।

Leave a Reply