মেয়েদের ঋতু চক্র: কখন হয়, কেন হয়, না হলে কী সমস্যা হয়? জেনে নিন বিস্তারিত।
*মেয়েদের ঋতু চক্র কী?
ঋতু চক্র বা মাসিক (Menstrual Cycle) হল নারীর শরীরে মাসিকভাবে ঘটে যাওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা সন্তান ধারণের প্রস্তুতির জন্য জরুরি। প্রতি মাসে জরায়ুতে একটিমাত্র ডিম্বাণু তৈরি হয় এবং তা গর্ভধারণের উপযোগী হয়। গর্ভধারণ না হলে, জরায়ুর আস্তরণ ভেঙে পড়ে ও রক্তপাতের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায় — এটাকেই মেয়েদের ঋতু চক্র বা মাসিক বলে।
*ঋতু চক্র কখন শুরু হয় ও কতদিন স্থায়ী হয়?
মেয়েদের প্রথম ঋতু চক্র সাধারণত ১০–১৫ বছর বয়সে শুরু হয়ে থাকে, যাকে বলা হয় মেনারকি (Menarche)।
একটি পূর্ণ ঋতু চক্র গড়ে ২৮ দিন হলেও, ২১–৩৫ দিনের মধ্যে হলে তা স্বাভাবিক ধরা হয়।
মাসিকের সময় রক্তপাত সাধারণত ৩–৭ দিন স্থায়ী হয়।
*ঋতু চক্র কীভাবে কাজ করে?
১. ব্রেইন থেকে নিঃসৃত হরমোন (FSH ও LH) ডিম্বাণু তৈরিতে সহায়তা করে।
২. প্রতি মাসে একটি ডিম্বাণু ডিম্বাশয় থেকে নির্গত হয় (Ovulation)।
৩. মাসিক শুরু হওয়ার পাঁচ দিনের পর থেকে একুশ দিন পর্যন্ত যদি পুরুষের সঙ্গে ঐ মহিলার যৌন মিলন না ঘটে বা জরায়ুর ভিতরে পুরুষ বীর্য প্রবেশ না করে তাহলে ঐ মহিলার গর্ভে বাচ্চা আসবে না বা গর্ভবতী হবে না অতএব গর্ভধারণ না হলে, জরায়ুর আস্তরণ ভেঙে রক্তের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায় — যাকে আমরা মাসিক বলি। এটাকে একটা গল্পের আকারে বলি, প্রথম মাসিক হওয়ার পাঁচ দিনের পর থেকে জরায়ুর ভিতরে সুন্দর করে বিছানা পেতে ডিম্বাণু তার প্রিয় জনের অপেক্ষায় বসে থাকে। এখানে প্রিয় জন অর্থাৎ পুরুষের বীর্যের মধ্যে থাকা ভ্রূণের কথা বলা হচ্ছে। ডিম্বাণু একটি সময় ধরে অপেক্ষা করে। যখন নির্দিষ্ট দিন পার হয়ে যাওয়ার পর অর্থাৎ নির্দিষ্ট দিন অপেক্ষা করার পরেও যখন ডিম্বাণুর আকাঙ্খিত ভ্রূণ আসে না তখন ডিম্বাণু সুন্দর করে পেতে রাখা সুসজ্জিত বিছানা অভিমান করে ছিঁড়ে ফেলে এবং সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এই কান্না টাই হচ্ছে রক্তপাত। এই ঘটনা টি প্রতি মাসে এক বার হয় বলে , একে মাসিক বলা হয়।
*ঋতু চক্র না হলে কী সমস্যা হয়?
মেয়েদের ঋতু চক্র বন্ধ বা অনিয়মিত হলে এটি শরীরের ভেতরের সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। যেমন:
১. হরমোনের সমস্যা (থাইরয়েড, প্রোল্যাকটিনের ভারসাম্যহীনতা)
২. PCOS বা PCOD
৩. অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা ওজন বৃদ্ধি হয়।
ঋতু চক্র না থাকলে হাড় ক্ষয়, হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, বন্ধ্যাত্ব ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
১. অনিয়মিত ঋতু চক্রের লক্ষণ।
২. মাসিকের সময় পরিবর্তন হওয়া
৩. অতিরিক্ত বা খুব কম রক্তপাত
৪. প্রচণ্ড পেটব্যথা
৫. মাসিক একবার হয়ে পরপর কয়েক মাস না হওয়া
৬. ব্রণ, চুল পড়া, মুখে লোম ওঠা ইত্যাদি
*ঋতু চক্র নিয়মিত রাখার উপায়:
১. সুস্থ খাদ্যাভ্যাস – প্রচুর সবজি, ফল, পানি, আয়রন ও ভিটামিন-যুক্ত খাবার।
২. নিয়মিত ব্যায়াম – হালকা ওয়ার্কআউট বা যোগব্যায়াম।
৩. ঘুম ও স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট।
৪. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
৫. প্রয়োজনে গাইনোকলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া।
*কখন ডাক্তার দেখানো উচিত?
(ক) টানা ৩ মাস ঋতু না হলে।
(খ) অস্বাভাবিক রক্তপাত হলে।
(গ) মাসিকের সময় প্রচণ্ড ব্যথা হলে।
(ঘ) গর্ভধারণে সমস্যা হলে।
(ঙ) হরমোনজনিত লক্ষণ দেখা দিলে।
*ঘরোয়া টিপস ও প্রাকৃতিক সমাধান:
(ক) আদা, তুলসী, মেথি ও দারচিনির চা ঋতুচক্র নিয়মিত করতে সাহায্য করে।
(খ) গরম জলের ব্যাগ ব্যথা উপশমে কার্যকর।
(গ) চিনি ও ফাস্ট ফুড কম খাওয়া উচিত।
*ঋতু চক্রের ৪টি ধাপ আছে:
১. Menstrual Phase বা রক্ত পাতের সময়।
২. Follicular Phase বা ডিম্বাণু প্রস্তুতির সময়।
৩. Ovulation Phase বা ডিম্বাণু নির্গমনের সময়।
৪. Luteal Phase বা ডিম্বাণু নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরবর্তী সময়।
মেয়েদের ঋতু চক্রে সাধারণ উপসর্গ বা পরিবর্তন:
১. স্তনে ব্যথা।
২. মুড সুইং বা খিটখিটে মেজাজ।
৩. খাবারের প্রতি আকর্ষণ।
৪. মাথা ব্যথা।
৫. ক্লান্তি বা অবসাদ।
মেয়েদের মাসিক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ মেনারকি(Menarche) থেকে মেনোপজ (Menopause) পর্যন্ত কয়েকটি রোগের সম্মুখীন হতে হয়। এখানে আমি রোগ গুলোর নাম বলবো।
১. ডিসমেনোরিয়া (Dysmenorrhea) বা বেদনা দায়ক মাসিক।
২. মেনোরেজিয়া (Menorrhagia) বা অতিরিক্ত রক্তপাত।
৩. Premenstrual Syndrome (PMS) বা মাসিক শুরু হওয়ার আগের উপসর্গ।
৪. Endometriosis (এন্ডোমেট্রিওসিস)।
৫. Amenorrhea (অ্যামেনোরিয়া) ।
Amenorrhea দুই ধরনের:
(ক) Primary Amenorrhea (প্রাইমারি অ্যামেনোরিয়া)।
(খ) Secondary Amenorrhea (সেকেন্ডারি অ্যামেনোরিয়া)।
এই রোগ গুলোর সম্পর্কে আমি বিস্তারিত জানাবো আমার পরের ব্লগে।
*শেষ কথা:
মেয়েদের ঋতু চক্র একটি স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া, যা প্রতিটি নারীর জীবনের অংশ। এটি নিয়ে লজ্জা নয়, বরং সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি। মাসিক অনিয়মিত হলে বা বন্ধ হলে অবশ্যই উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে হবে। সুস্থ জীবনধারা মেনে চললে ঋতু চক্র নিয়মিত থাকবে এবং শারীরিক-মানসিক সুস্থতা বজায় থাকবে। নিয়মিত শরীরচর্চা করা উচিত।