লিভার ক্যান্সার সম্পর্কে জানুন: কারণ, প্রাথমিক লক্ষণ ও কার্যকর চিকিৎসা
লিভার ক্যান্সার কীভাবে হয়, এর প্রাথমিক লক্ষণ, কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন। সময়মতো শনাক্ত ও সঠিক চিকিৎসা জীবন বাঁচাতে পারে।
ভূমিকা:
বর্তমান সময়ে ক্যান্সার একটি ভয়ঙ্কর ও প্রাণঘাতী রোগ হিসেবে পরিচিত, যার মধ্যে লিভার ক্যান্সার এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে লিভার একটি প্রধান অঙ্গ, যা রক্ত পরিশোধন, হজমে সহায়তা এবং বিভিন্ন উপাদান সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট কারণে এই লিভারেই জন্ম নিতে পারে ক্যান্সার কোষ, যা সময়মতো শনাক্ত না হলে প্রাণঘাতী হতে পারে।
এই ব্লগ পোস্টে আমরা আলোচনা করব লিভার ক্যান্সারের সম্ভাব্য কারণ, প্রথমদিকের লক্ষণ এবং আধুনিক ও কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে, যাতে সময়মতো সচেতন হয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
World Health Organization (WHO) – Liver Cancer: তথ্যসূত্র:
আমরা আজকে এই ব্লগে জানবো –
১. লিভার ক্যান্সার কী?
২. লিভার ক্যান্সারের কারণসমূহ।
৩. লিভার ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ ও উপসর্গ।
৪. কীভাবে লিভার ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়?
৫. লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি।
৬. লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়।
বিস্তারিত নিচে দেওয়া হলো:
১. লিভার ক্যান্সার কী?
লিভার ক্যান্সার হলো এমন একটি রোগ যেখানে লিভারের কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়। সাধারণত শরীরের কোষগুলো নির্দিষ্ট নিয়মে বিভাজিত হয় ও বেড়ে ওঠে, কিন্তু ক্যান্সার কোষগুলো এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে অমান্য করে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজিত হতে থাকে, যার ফলে টিউমার তৈরি হয়।
American Cancer Society – Liver Cancer: তথ্যসূত্র:
লিভার ক্যান্সার প্রধানত দুই ধরনের হতে পারে:
(ক) প্রাইমারি লিভার ক্যান্সার (Primary Liver Cancer):
এই ধরনের ক্যান্সার লিভারে শুরু হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হলো Hepatocellular Carcinoma (HCC), যা লিভারের প্রধান কোষ হেপাটোসাইটে শুরু হয়।
(খ) সেকেন্ডারি বা মেটাস্টেটিক লিভার ক্যান্সার (Secondary Liver Cancer):
এই ক্যান্সার লিভারে শুরু না হয়ে শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ (যেমনঃ ফুসফুস, স্তন, কোলন ইত্যাদি) থেকে ছড়িয়ে পড়ে।
লিভার ক্যান্সার ধীরে ধীরে হলেও অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, যদি সময়মতো নির্ণয় ও চিকিৎসা না করা হয়। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণ চিনে নেওয়া ও সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।
২. লিভার ক্যান্সারের কারণসমূহ:
লিভার ক্যান্সার হঠাৎ করে হয় না—এর পেছনে থাকে একাধিক ঝুঁকিপূর্ণ কারণ ও দীর্ঘদিনের অসুস্থতা। নিচে কিছু প্রধান কারণ উল্লেখ করা হলো:
(ক) হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস সংক্রমণ
এই দুটি ভাইরাস লিভারে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা সময়ের সাথে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। হেপাটাইটিস বি/সি আক্রান্ত ব্যক্তি যদি চিকিৎসা না করে, তাহলে তার লিভার সিরোসিস এবং ক্যান্সারে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
(খ) লিভার সিরোসিস (Liver Cirrhosis)
সিরোসিস হলো লিভার কোষ ধ্বংস হয়ে স্থানে স্থানে চামড়া ও দাগ তৈরি হওয়া। এটি সাধারণত দীর্ঘদিনের অ্যালকোহল সেবন, হেপাটাইটিস সংক্রমণ অথবা ফ্যাটি লিভার-এর কারণে হয়। সিরোসিস রোগীদের মধ্যে লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেশি।
(গ) অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ
দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করলে লিভারে ক্ষতি হয় এবং সিরোসিস দেখা দিতে পারে, যা পরবর্তীতে ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
(ঘ) নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD)
ওবেসিটি, ডায়াবেটিস ও অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে লিভারে চর্বি জমে গিয়ে NAFLD হতে পারে। এই অবস্থাও লিভারকে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত করে ক্যান্সারের দিকে ঠেলে দেয়।
(ঙ) আফ্লাটক্সিন বিষক্রিয়া
আফ্লাটক্সিন এক ধরনের ছত্রাকজাত টক্সিন যা বাসি বা সংরক্ষিত খাদ্য (যেমন: চাল, ডাল, বাদাম) থেকে উৎপন্ন হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই বিষ গ্রহণ করলে লিভারের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ক্যান্সার হতে পারে।
(চ) বংশগত জিনগত সমস্যা
কিছু কিছু ক্ষেত্রে জেনেটিক বা বংশগত কারণে লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে, বিশেষত যদি পরিবারে পূর্বে কারও এই রোগ হয়ে থাকে।
(ছ) ধূমপান ও বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শ
ধূমপান, কীটনাশক, প্লাস্টিক বা অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শ লিভারের কোষে পরিবর্তন এনে ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
৩. লিভার ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ ও উপসর্গ:
প্রাথমিক লক্ষণ ও উপসর্গ-
লিভার ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ না-ও পেতে পারে। অনেক সময় রোগী বুঝতেই পারে না যে তার লিভারে কোনো সমস্যা হচ্ছে। তবে কিছু সাধারণ উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যা অবহেলা না করে গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ তুলে ধরা হলো:
(ক) অস্বাভাবিক ক্লান্তি ও দুর্বলতা:
দিনের পর দিন অল্পতেই ক্লান্ত লাগা বা কোনো কাজ করতে না পারা—এটি লিভার ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।
(খ) অজানা কারণে ওজন হ্রাস
হঠাৎ করে খাওয়া-দাওয়া ঠিক থাকা সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া ক্যান্সারের একটি সাধারণ উপসর্গ।
(গ) ক্ষুধামান্দ্য ও হজমে সমস্যা
লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে ক্ষুধা কমে যায় এবং রোগী প্রায়ই হজমে সমস্যা অনুভব করে।
(ঘ) পেটের ডানদিকে ব্যথা বা অস্বস্তি
বিশেষ করে পেটের উপরের ডান পাশে ব্যথা বা চাপ লাগা লিভারে সমস্যা নির্দেশ করতে পারে।
(ঙ) পেটে ফাঁপাভাব বা তরল জমা হওয়া (Ascites)
লিভারে টিউমার বেড়ে গেলে পেট ফুলে যায় এবং অনেক সময় পেটের ভিতরে তরল জমে যায়।
(চ) জন্ডিস (চোখ ও ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া)
লিভারের কার্যক্ষমতা কমে গেলে বিলিরুবিন নিঃসরণ কম হয়, ফলে চোখ ও ত্বক হলদে হয়ে যায়।
(ছ) বমি ভাব বা বমি হওয়া
অতিরিক্ত ক্লান্তির পাশাপাশি বমি ভাব বা মাঝে মাঝে বমি হওয়া লিভারের অসুস্থতার ইঙ্গিত দিতে পারে।
(জ) মলের রং সাদা বা মল কালো হওয়া
লিভার স্বাভাবিকভাবে বাইল তৈরি না করলে মলের রঙ পরিবর্তন হতে পারে।
এই উপসর্গগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ সময়মতো চিকিৎসা শুরু করলে লিভার ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে।
৪. কীভাবে লিভার ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়?
লিভার ক্যান্সার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে চিকিৎসা অনেক বেশি সফল হতে পারে। এজন্য সঠিক সময়ে সঠিক পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে লিভার ক্যান্সার নির্ণয়ের প্রধান পদ্ধতিগুলো তুলে ধরা হলো:
(ক) শারীরিক পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ
চিকিৎসক রোগীর শারীরিক লক্ষণ, যেমন—পেট ফুলে যাওয়া, চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া, ক্লান্তিভাব ইত্যাদি লক্ষণ দেখে প্রাথমিকভাবে ধারণা নেন।
(খ) রক্ত পরীক্ষা (AFP Test)
Alpha-fetoprotein (AFP) একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন, যা লিভার ক্যান্সারের ক্ষেত্রে রক্তে উচ্চমাত্রায় উপস্থিত থাকে। তবে সবক্ষেত্রে এটি নির্ভরযোগ্য না হলেও অনেক সময় প্রাথমিক ধারণা দেয়।
(গ) আল্ট্রাসনোগ্রাফি (Ultrasound)
লিভারের অবস্থা দেখতে এবং সেখানে কোনো অস্বাভাবিকতা (যেমন টিউমার বা ফোলাভাব) আছে কি না তা নির্ধারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ।
(ঘ) সিটি স্ক্যান (CT Scan) ও এমআরআই (MRI)
এই দুই ধরনের ইমেজিং পদ্ধতি লিভারের ভেতরের গঠন পরিষ্কারভাবে দেখাতে সাহায্য করে। টিউমারের অবস্থান, আকার এবং আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছে কি না—এসব জানা যায়।
(ঙ) বায়োপসি (Biopsy)
লিভারের টিস্যু থেকে একটি ছোট নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে এই কোষ বিশ্লেষণ করে নিশ্চিতভাবে বলা যায় এটি ক্যান্সার কিনা।
(চ) ল্যাপারোস্কপি (Laparoscopy)
এটি একটি ছোট অপারেশন পদ্ধতি যার মাধ্যমে সরাসরি লিভারকে দেখা হয় এবং প্রয়োজনে টিস্যু সংগ্রহ করা হয়। এটি জটিল কেসে প্রয়োগ করা হয়।
নির্ভরযোগ্য পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত নির্ণয়ই লিভার ক্যান্সার মোকাবিলার প্রথম ধাপ।
৫. লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি:
লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর বয়স, শারীরিক অবস্থা, ক্যান্সারের ধরণ, অবস্থান ও কতদূর ছড়িয়েছে তার ওপর। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এখন নানা ধরনের পদ্ধতি রয়েছে, যেগুলোর সাহায্যে লিভার ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ বা নিরাময় করা সম্ভব হয়। নিচে প্রধান প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো তুলে ধরা হলো:
(ক) অস্ত্রোপচার (Surgery)
যদি ক্যান্সারটি লিভারের নির্দিষ্ট একটি অংশে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে সেই অংশটি কেটে ফেলে দেওয়া যায়। একে বলে “Partial Hepatectomy”। এটি কেবল তখনই করা হয়, যখন লিভারের অবশিষ্ট অংশ ভালোভাবে কাজ করতে সক্ষম।
(খ) লিভার ট্রান্সপ্লান্ট (Liver Transplantation)
যদি ক্যান্সারটি পুরো লিভারে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সম্পূর্ণ লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়। এই পদ্ধতিতে ডোনার লিভার ব্যবহার করা হয়। এটি দীর্ঘমেয়াদি সফলতা দিতে পারে, তবে উপযুক্ত ডোনার পাওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
(গ) রেডিওথেরাপি (Radiotherapy)
রেডিওথেরাপির মাধ্যমে উচ্চমাত্রার রশ্মি ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়। এটি সাধারণত অন্য চিকিৎসার পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে ব্যথা কমানোর জন্য।
(ঘ) কেমোথেরাপি (Chemotherapy)
এই পদ্ধতিতে ওষুধ ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করা হয়। সাধারণত শিরার মাধ্যমে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, তবে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে যেমন বমি, চুল পড়া, ক্লান্তি ইত্যাদি।
(ঙ) টার্গেটেড থেরাপি (Targeted Therapy)
এই চিকিৎসায় ক্যান্সার কোষের নির্দিষ্ট জিন বা প্রোটিন লক্ষ্য করে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, যাতে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি থেমে যায়। এটি তুলনামূলকভাবে আধুনিক ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করে।
(চ) ইমিউনোথেরাপি (Immunotherapy)
এই থেরাপিতে রোগীর শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (immune system) কে সক্রিয় করা হয় ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। এটি কিছু নির্দিষ্ট ধরণের লিভার ক্যান্সারের জন্য কার্যকর হতে পারে।
(ছ) লোকাল থেরাপি (Local Therapy)
এগুলো এমন কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি, যা সরাসরি টিউমারের উপর প্রয়োগ করা হয়:
Radiofrequency Ablation (RFA) – তাপ ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়।
Transarterial Chemoembolization (TACE) – ক্যান্সারের রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয় ও সরাসরি ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
প্রতিটি চিকিৎসার সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে, এবং চিকিৎসক রোগীর অবস্থা অনুযায়ী সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি বেছে নেন।
National Cancer Institute – Liver Cancer Treatment: তথ্যসূত্র:
৬. লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধে করণীয়:
লিভার ক্যান্সার থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে রক্ষা করা সম্ভব যদি আমরা কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস মেনে চলি। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা ও করণীয় তুলে ধরা হলো:
(ক) হেপাটাইটিস ভাইরাসের টিকাদান করান
হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ। তাই হেপাটাইটিস বি’র টিকা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া, হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা করান।
(খ) নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান
বিশেষত যারা লিভারের ঝুঁকিতে আছেন (যেমন হেপাটাইটিস আক্রান্ত, লিভার সিরোসিস রোগী), তাদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো উচিত।
(গ) অ্যালকোহল সেবন সীমিত করুন
অতিরিক্ত মদ্যপান লিভারের জন্য ক্ষতিকর। তাই অ্যালকোহল গ্রহণ সীমিত করুন বা সম্পূর্ণ পরিহার করুন।
(ঘ) স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করুন
সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খান, যেখানে প্রচুর ফল, সবজি ও ফাইবার থাকে। তেল-মসলাযুক্ত ও জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলুন।
(ঙ) ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
অতিরিক্ত ওজন ও মোটা হওয়া লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন।
(চ) পরিশ্রমী ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করুন
পরিবেশ ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন, বিশেষ করে খাদ্যসংক্রান্ত সচেতনতা জরুরি।
(ছ) ধূমপান থেকে বিরত থাকুন
ধূমপান ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে, তাই ধূমপান না করাই শ্রেয়।
(জ) খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণে সতর্কতা অবলম্বন করুন
বাসি ও ছত্রাকযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন যাতে আফ্লাটক্সিনের সংস্পর্শ এড়ানো যায়।
এই সতর্কতাগুলো মেনে চললে লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
উপসংহার:
লিভার ক্যান্সার একটি নীরব ঘাতক, যা প্রাথমিক অবস্থায় তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করায় অনেক সময় দেরিতে শনাক্ত হয়। তবে সচেতনতা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এই রোগ প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি।
যদি শরীরে অস্বাভাবিক কিছু অনুভব করা যায়—যেমন অনিয়মিত পেটব্যথা, চোখ বা ত্বকে হলদে ভাব, অস্বাভাবিক ক্লান্তি ইত্যাদি—তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির কল্যাণে আজ লিভার ক্যান্সার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তই পারে জীবন বাঁচাতে। নিজের এবং পরিবারের সুস্থতার জন্য আজ থেকেই সচেতন হই, সাবধান হই।
প্রায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলি (FAQ):
প্রশ্ন ১: লিভার ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ কী কী?
উত্তর: প্রাথমিকভাবে ক্লান্তিভাব, ওজন হ্রাস, পেটের ডান দিকে ব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য, চোখ ও ত্বকে হলুদ ভাব (জন্ডিস), এবং বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে।
প্রশ্ন ২: লিভার ক্যান্সার কি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য?
উত্তর: প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে ও দ্রুত চিকিৎসা শুরু হলে কিছু ক্ষেত্রে লিভার ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব। তবে তা রোগীর শারীরিক অবস্থা, ক্যান্সারের ধরণ ও বিস্তারের ওপর নির্ভর করে।
প্রশ্ন ৩: লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ কী?
উত্তর: হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন, লিভার সিরোসিস, স্থূলতা, ও আফ্লাটক্সিন যুক্ত খাবার লিভার ক্যান্সারের মূল কারণ।
প্রশ্ন ৪: লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধে করণীয় কী?
উত্তর: হেপাটাইটিস বি-এর টিকাদান, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা—এসবের মাধ্যমে লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্ভব।
প্রশ্ন ৫: লিভার ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য কোন কোন পরীক্ষা করা হয়?
উত্তর: AFP রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, CT স্ক্যান, MRI, বায়োপসি ও ল্যাপারোস্কপি মাধ্যমে লিভার ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়।
প্রশ্ন ৬: লিভার ক্যান্সার ছোঁয়াচে (সংক্রামক) রোগ কি?
উত্তর: না, লিভার ক্যান্সার নিজে ছোঁয়াচে নয়। তবে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে রক্ত বা শারীরিক তরলের মাধ্যমে, যা ভবিষ্যতে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
প্রশ্ন ৭: লিভার ক্যান্সার কোন বয়সে বেশি দেখা যায়?
উত্তর: সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পর লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে, তবে হেপাটাইটিস বা লিভার সিরোসিস থাকলে আরও কম বয়সেও দেখা দিতে পারে।
প্রশ্ন ৮: কি ধরণের খাদ্য লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে?
উত্তর: ফাইবারযুক্ত ফল ও সবজি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার (যেমন: বিট, গাজর, লেবু), জলীয় খাদ্য, এবং পর্যাপ্ত পানি পান লিভারের জন্য উপকারী। প্রক্রিয়াজাত ও ফাস্টফুড এড়িয়ে চলা উচিত।
প্রশ্ন ৯: হেপাটাইটিস থাকলে কি লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি?
উত্তর: হ্যাঁ, দীর্ঘদিন হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসে আক্রান্ত থাকলে লিভার সিরোসিস এবং পরবর্তীতে লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
প্রশ্ন ১০: কি ধরনের চিকিৎসা লিভার ক্যান্সারে প্রয়োগ করা হয়?
উত্তর: অপারেশন (surgery), কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি, এবং লিভার ট্রান্সপ্লান্ট — এসব চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে নির্দিষ্ট রোগীর জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি বেছে নেওয়া হয়।
প্রশ্ন ১১: লিভার ক্যান্সার কি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে?
উত্তর: হ্যাঁ, কিছু ধরণের লিভার ক্যান্সার খুব দ্রুত শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই দ্রুত নির্ণয় ও চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি।
প্রশ্ন ১২: লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যয় কত হতে পারে?
উত্তর: চিকিৎসার ধরণ, হাসপাতালের ধরন ও রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে খরচ পরিবর্তিত হয়। সাধারণত চিকিৎসা ব্যয় বেশ উচ্চ হয়, বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালে।
প্রশ্ন ১৩: লিভার ক্যান্সার কি বংশগত হতে পারে?
উত্তর: সরাসরি বংশগত না হলেও, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হেপাটাইটিস বা লিভারের অসুখ থাকলে ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন ১৪: লিভার ক্যান্সার ও ফ্যাটি লিভারের মধ্যে কী পার্থক্য?
উত্তর: ফ্যাটি লিভার মানে লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়া, যা একটি প্রাথমিক অবস্থা। এটি সময়মতো চিকিৎসা না হলে সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। তবে ফ্যাটি লিভার নিজে ক্যান্সার নয়।
প্রশ্ন ১৫: লিভার ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার পর গড় আয়ু কতদিন?
উত্তর: এটি ক্যান্সারের স্টেজ, রোগীর বয়স, শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসার ওপর নির্ভর করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে বহু বছর বাঁচা সম্ভব, তবে পরবর্তী পর্যায়ে রোগীর গড় আয়ু অনেক কমে যায়।
প্রশ্ন ১৬: লিভার ক্যান্সারের জন্য কি বিশেষ কোনো ডায়েট অনুসরণ করতে হয়?
উত্তর: হ্যাঁ, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কম চর্বিযুক্ত, সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাদ্য খেতে হয়। পর্যাপ্ত পানি ও ফাইবারযুক্ত খাবার গ্রহণ জরুরি।
প্রশ্ন ১৭: লিভার ক্যান্সারের স্ক্রিনিং কখন করতে হবে?
উত্তর: যাদের হেপাটাইটিস বি বা সি রয়েছে, যাদের পরিবারে লিভারের অসুখ আছে বা যারা অ্যালকোহল সেবন করেন, তাদের বছরে অন্তত একবার স্ক্রিনিং করানো উচিত।
প্রশ্ন ১৮: লিভার ক্যান্সারের জন্য বায়োপসি কি সব সময় দরকার হয়?
উত্তর: না, সব ক্ষেত্রে বায়োপসি প্রয়োজন হয় না। কখনো কখনো CT স্ক্যান বা MRI থেকেই স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তবে সন্দেহজনক ক্ষেত্রে বায়োপসি করা হয়।
প্রশ্ন ১৯: লিভার ট্রান্সপ্লান্ট কি লিভার ক্যান্সারের জন্য কার্যকর?
উত্তর: হ্যাঁ, নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে (যেমন: ছোট আকারের ক্যান্সার বা হেপাটোকেলুলার কারসিনোমা) লিভার ট্রান্সপ্লান্ট কার্যকর ও জীবনরক্ষা করতে পারে।
প্রশ্ন ২০: লিভার ক্যান্সার হলে ব্যথা হয় কি?
উত্তর: হ্যাঁ, রোগের পর্যায়ে এবং টিউমারের অবস্থানের উপর নির্ভর করে পেটের ডান পাশে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। অনেক সময় ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়ে।
আরো বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।