গরম কালে গরমের প্রকোপে শরীরে অতিরিক্ত ঘাম হয় যার জন্য জলের ঘাটতি হয় কোন ব্যক্তি যদি গরম কালে সঠিক পরিমাণে জল না পান করে তাহলে ঘামের জন্য তার শরীরে জলের ঘাটতি হয়ে যায় এটাকেই ডিহাইড্রেশন বা শরীরের জল শুন্য ঘটনা বলে।গরমকালে শরীরে জলের ঘাটতি হওয়া খুবই সাধারণ বিষয়। একে ডিহাইড্রেশন বলা হয়। এটি যদি সময়মতো প্রতিকার না করা হয়, তাহলে তা গুরুতর শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে। এই পোস্টে আমরা জানব ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকারের সহজ ও কার্যকর উপায়।
১. ডিহাইড্রেশন কী?
ডিহাইড্রেশন হলো শরীরের স্বাভাবিক জলের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া, অর্থাৎ যখন শরীর যতটা জল হারায়, ঠিক ততটাই জল পুনরায় গ্রহণ করা হয় না বলে শরীরে জলের ঘাটতি দেখা দেয়। তখন শরীরে যে অবস্থা হয় তাকেই ডিহাইড্রেশন। অর্থাৎ ডিহাইড্রেশন কথার অর্থ হচ্ছে শরীরের জল ও ইলেক্ট্রোলাইটের ঘাটতি।
*ডিহাইড্রেশন হলে কেন শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়?
ডিহাইড্রেশন হলে শরীরের কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় থাকার কারণ গুলো নিচে দেওয়া হলো —
শরীরের প্রায় ৬০-৭০% অংশ জল দিয়ে তৈরি হয়। তাই এই জল শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ চালাতে সাহায্য করে। যেমন:
১. কোষের কার্যকলাপ ঠিক রাখতে সাহায্য করে:
প্রতিটি কোষে পানি দরকার তার কাজ চালাতে। জল না থাকলে কোষগুলো সঠিকভাবে শক্তি উৎপাদন, বর্জ্য নিষ্কাশন ইত্যাদি করতে পারে না।
২. রক্তচাপ ও রক্ত সঞ্চালন বজায় রাখতে সাহায্য করে:
শরীরের রক্তের বড় অংশ জল দিয়ে গঠিত হয় তাই ডিহাইড্রেশন হলে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায়, ফলে হৃৎপিণ্ডকে বেশি চাপ দিয়ে রক্ত পাম্প করতে হয়, যা ক্লান্তি ও মাথা ঘোরা তৈরি করে।
৩. তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে:
শরীর ঘাম দিয়ে গরম হলে ঠান্ডা করে। তাই শরীরে জল না থাকলে ঘাম হয় না, ফলে বডি টেম্পারেচার বেড়ে গিয়ে হিট স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে। আর স্ট্রোক হলে প্যারালাইসিস ও হয়ে যেতে পারে।
৪. পাচনতন্ত্রের কাজের জন্য সাহায্য করে:
হজমের জন্য এবং খাদ্য নরম রাখতে জলের দরকার হয়। তাই ডিহাইড্রেশন হলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়, হজমের সমস্যা দেখা দেয়।
৫. বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য সাহায্য করে:
কিডনি ও প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীরের টক্সিন বের হয় জল দিয়েই তাই জল শরীরে না থাকলে কিডনি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, প্রস্রাব কমে যায় ও রঙ গাঢ় হয়ে যায়।
সারসংক্ষেপে বলা যায়:
ডিহাইড্রেশন হলে শরীর যেন ঠিকমতো মেশিনের মতো কাজ করতে পারে না, কারণ প্রতিটি সিস্টেম (হজম, রক্ত সঞ্চালন, কিডনি, স্নায়ু) এর জন্যই পর্যাপ্ত জল দরকার হয়।
2. ডিহাইড্রেশনের প্রকারভেদ:
(ক) মাইল্ড (হালকা)
মাইল্ড ডিহাইড্রেশন মানে শরীরে অল্প মাত্রায় জলের ঘাটতি হয়েছে বোঝায়। এটি সাধারণত তখনই হয়, যখন আপনি পর্যাপ্ত জল পান করছেন না । এবং হালকা ঘাম, বমি, ডায়রিয়ার কারণে শরীর থেকে অল্প পরিমাণে জল বেরিয়ে যাচ্ছে।
মাইল্ড ডিহাইড্রেশনকেও অবহেলা করা উচিত নয়। শরীর একটু কিছু সংকেত দিলেই জল পান করে বা ঘরোয়া উপায়ে তা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করুন। হাইড্রেটেড থাকুন, সুস্থ থাকুন।
(খ) মডারেট (মাঝারি)
মডারেট ডিহাইড্রেশন হলো শরীরে মাঝারি মাত্রায় জল ও ইলেক্ট্রোলাইটের ঘাটতি হয়, যা হালকা ডিহাইড্রেশন থেকে আরও একধাপ বেশি গুরুতর। এই অবস্থায় শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত হতে শুরু করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
মডারেট ডিহাইড্রেশন শরীরকে দুর্বল করে ফেলে এবং দ্রুত অ্যাকশন না নিলে তা সিভিয়ার ডিহাইড্রেশনে পরিণত হতে পারে, যা জীবন ঝুঁকির কারণ হতে পারে। তাই এই পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই হাইড্রেটেড থাকা এবং সচেতন হওয়া জরুরি।
(গ) সিভিয়ার (তীব্র)
সিভিয়ার ডিহাইড্রেশন হলো শরীরে চরম মাত্রায় পানি ও ইলেক্ট্রোলাইটের ঘাটতি, যেখানে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে। এটি একটি জরুরি চিকিৎসা পরিস্থিতি, যা সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে জীবনহানির কারণও হতে পারে।
সিভিয়ার ডিহাইড্রেশন কখনোই অবহেলা করার মতো নয়। লক্ষণগুলো দেখা দিলেই দেরি না করে চিকিৎসা নিতে হবে। সময়মতো পদক্ষেপই পারে একটি জীবন বাঁচাতে।
২. ডিহাইড্রেশনের কারণ:
(ক) অতিরিক্ত ঘাম হওয়া।
(খ) পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি না খাওয়া।
(গ) বমি বা ডায়ারিয়া হওয়া।
(ঘ) উচ্চ তাপমাত্রায় কাজ করা।
(ঙ) ডায়াবেটিস কারণে বেশি বেশি প্রস্রাব হলে ডিহাইড্রেশন হতে পারে বা হয়।
(চ) অতিরিক্ত জ্বর হলে ডিহাইড্রেশন হতে পারে।
৩. ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ:
(ক) অতিরিক্ত পিপাসা পায়।
(খ) মুখ শুকিয়ে যায়।
(গ) প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়।
(ঘ) প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হয়ে যায়।
(ঙ) মাথা ঘোরে বা দুর্বলভাব লাগে।
(চ) ত্বক শুকিয়ে যায় ও প্রাণহীন হয়ে যায়।
(ছ) হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে যায়।
(জ) শিশুদের যখন ডিহাইড্রেশন হয় তখন শিশুরা কান্না করলে চোখে জল আসে না। তখনই বুঝতে হবে ঐ শিশুটির ডিহাইড্রেশন হয়েছে।
(ঝ) চোখ বসে যায়।
(ঞ) ক্লান্তিতে ভোগেন।
(ট) হাত পা অবশ হতে থাকে।
৪. প্রতিকার ও ঘরোয়া উপায়:
(ক) দিনে অন্তত ৮–১০ গ্লাস জল পান করুন।
(খ) ঠাণ্ডা জলযুক্ত ফল যেমন তরমুজ, শসা, আনারস বেশি খান
(গ) নারকেল জল, ওআরএস (ORS) বা লেবু-লবণ জল পান করুন
(ঘ) সরাসরি রোদ এড়িয়ে চলুন।
(ঙ) শিশু ও বয়স্কদের প্রতি আলাদা নজর দিন।
৫. কবে ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন:
(ক) বারবার বমি বা ডায়ারিয়া হলে বা
প্রস্রাব একেবারেই না হলে।
(খ)অতিরিক্ত দুর্বলতা, মাথা ঘোরা বা চেতনা হারানোর প্রবণতা দেখা দিলে।
উপসংহার:
ডিহাইড্রেশন এমন এক সমস্যা যা সচেতন থাকলেই প্রতিরোধ করা যায়। গরমকালে সঠিক পরিমাণে তরল গ্রহণ এবং শরীরকে ঠাণ্ডা রাখা জরুরি। ছোট ছোট অভ্যাসই আপনাকে সুস্থ রাখতে পারে।
ডিহাইড্রেশন বা শরীরে পানিশূন্যতা একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, যা দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। পর্যাপ্ত পানি ও তরল গ্রহণের অভাবে এটি দেখা দেয়, বিশেষত গরমকাল, শারীরিক পরিশ্রম বা অসুস্থতার সময়। ডিহাইড্রেশনের লক্ষণগুলো যেমন মাথাব্যথা, দুর্বলতা, মাথাঘোরা এবং প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া ইত্যাদি চিন্হিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পান, তরলজাতীয় খাবার (যেমন ডাবের পানি, স্যালাইন, ফলের রস) গ্রহণ এবং অতিরিক্ত ঘাম হলে ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। শিশু, বৃদ্ধ এবং ক্রীড়াবিদদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন।সঠিক সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ডিহাইড্রেশনের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। তাই, সুস্থ থাকতে পানিকে প্রতিদিনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।